লোক মুখে শুনেছি কপালে না থাকলে সামনে থাকলেও তা পাওয়া যায় না। আমার অবস্থাও ঠিক তেমনই আমার অবস্থা। আমার কপালে না থাকার কারনে আমি শুধু দেখি অনের সুখ। যে সুখের আশা আমি করেছিলাম কিন্তু ভাগ্য আমার সেই সুখ লেখা নাই। আমি আমার জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত কোন সুখ পেলাম না শুধু সুখের আশাই করেছি। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার মা বলতো এখন কষ্ট তো ভবিষ্যতে সুখ কিন্তু আমার বর্তমানও কষ্টের।
ছোট সময় আমার বাবার আয় কেমন ছিল তা আজি জানি না। আমার বাবা অনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছে তা আমি জানি। আমার বোন আমার বাবার অভাব দেখেছে কিন্তু আমি আমার বাবার অভাব দেখিনি। আমার বাবা মুহুরী পেশায় যখন আসে তখন আমি ছোট। আমার বাবা মুহুরি পেশার আসার পর নাকি আমাদের উন্নতি হয় যেটা আমার মায়ের কথা। আমি আর মা গ্রামে থাকতাম আর বোন আর বাবা শহরে। সেই ২০০২ সালে বাবা শহরে আসে আর বোন ২০০৩ সালে। আমি মায়ের সাথে গ্রামে থাকি। আমার বাবা তখন কত টাকা আয় করতো তা আমি জানি না। তবে এটা দেখতাম বাবা মাকে সংসারের জন্য যে টাকা খরচ করতে দিতো তা মা পুরোটাই জমিয়ে রাখতো। ছোট সময় দেখতাম আমার মা কখন বাজার করতো না। সে মাছ থেকে শুরু করে সবজি পর্যন্ত সব জোগান দিত। আমাদের গ্রামে বেশির ভাগ মানুষই মাছ ধরতো। আমার মেঝ কাকা বড় ফুফু এরা মাছ ধরেই জীবিকা চালাত। খালে জাল ফেলে জাল তোলার সময় মাছের সাথে অনেক ময়লা উঠতো আর তখন ময়লা থেকে মাছ আদালা করতে হতো। সেই সময় আমার মা তাদের সাথে ময়লা থেকে মাছ বেছে আদালা করতো। তখন তারা আমার মাকে খাবার জন্য মাছ দিতো। আবার কোন কোন সময় আমি আর মা খালে মাছ দরেছি। কখন আমার মা বাজার থেকে মাছ কিনতো না কিন্তু বাবা মাকে মাছ কেনার জন্য টাকা দিতো। তাছাড়া আমাদের পুকুরে তো বাবা মাছ চাষ করে রাখতো খাওয়ার জন্য। কিন্তু মা তাও ধরাতো না। এমনকি আমাকেও ধরতে দিতো না। যখন বাবা আসতো তখন বাবা পুকুর থেকে মাছ ধরতো। বাবা যখন বাড়ীতে তখন মা রুটি পিঠা বানাতো আর বাবা আসার সময় বাজার থেকে মুরগী কিনে আনতো তা রান্না করতো। আমরা সপ্তাহে সুধু ঐ একটি দিন (শুক্র বার) রুটি পিঠা আর মাংস খেতাম।
শুধু খাবারই না আমার মা সব কিছুতেই হিসাবি ছিলো। আমার মা তার নিজের পড়নের শাড়ি কেনার টাকাও বাবার কাছ থেকে নিয়ে তা জমা রাখতো। মা তার শাড়ী একেবারে নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত সে নতুন শাড়ি কিনতো না। সুধু মায়ের না আমার জামা-কাপড়ও, বাবা আমার জন্য জামা-কাপড় নতুন কিনে দিতো। কিন্তু আমার লুঙ্গী একেবাড়ে ছিড়ে যাওয়ার পর মা আমাকে লুঙ্গী পড়তে দিতো না। বাবা টাকা ঠিক মতোই দিতো কিন্তু মা তা খরচ করতে চাইতো না। আমার প্যান্ট ছিড়ে যেতো মা তা সেলাই করে দিতো। তবুুও নতুন কেনা প্যান্ট আমাকে পরতে দিতো না। আমি মাকে জিজ্ঞেস করতাম “ মা আমরা কেনো এরকম খাই। মানুষ সপ্তাহে তিন দিন বড় মাছ খায় আমরা খাইনা। তুমি আমাকে নতুন জামা-কাপড় পরতে দেও না। কে এমন করো?” তখন মা আমাকে বলে এখন যদি সব টাকা পয়সা খরচ করি তাহলে ভবিষ্যতে কি করবো। আমরা শহরে একটা বাড়ি করবো, তোর চাকরীর জন্য টাকা লাগবে, তোর চাকুরী না হলে ভবিষ্যতে তোর ব্যবসা করলেও তো ব্যবসার জন্য টাকা লাগবে। তোর ভবিষ্যতের চিন্তা করেই তো আমি এমন করি। কিন্তু কে যানে আমার কপালে সুখ লেখা নাই। বাবা যে টাকা আয় করেছে তা যদি আমরা মা তার বর্তমান স্ত্রীর মতো খরচ করতো তাহলে আমরা খেয়েপড়ে সমান থাকতাম। আমাদের কোন জমা থাকতো না। টাকা তো আমার মা আয় করে নি আমার বাবাই করেছে কিন্তু মা সেটা ধরে রেখেছে। বাবার সংসার খরচ ও তার নিজের খরচ, বোনের খচর করার পরেও যে টাকা থাকতো তা বাবা মাকে দিতো। মা সে টাকা জমা করতো। সারা বছরে বাবা যে সব টাকা মাকে দিতো সব টাকা এক করে আবার মা তাকে দিতো তা বাবা ব্যাংকে জমা করতো।
বাবা যখন টাকাগুলো একসাথে করে নিতো তখন বাবা আমাকে বলতো গুনতো এখানে কত টাকা আছে। তখন বাবা বলতো এই টাকা তোর ভবিষ্যতের জন্য।
কিন্তু তখন আমরা কি জানতাম যে কপাল নামকও একটি জিনিস আছে। আর কপালে না থাকলে সে তা পায় না। আমার কপালে সুখ লেখা নাই তাই আমি পাইনি। আর সে সুখ অন্য কেউ পেছেয়ে আমার বাবার সংসারে। আর তার সুখের জন্য আমার বাবাও আমাকে ভুলে গেছে।
আমি ছিলাম আমার বাবার কলিজার টুকরা আর এখন বাবার চক্ষুশূল তাও তো আমার কপালের দোষে।
কপালের দোষে বাবা আজ আমার হাত ছেড়ে দিয়েছে। এখন বাবার কাছে আমি একটা বিষ বৃক্ষ। সবই আমার কপাল।
আগে আমি না খেয়ে থাকমাত জমানোর জন্য এখন আমি না খেয়ে থাকি অভাবের জন্য। আগে প্রতি দিন সকালে মরিচ দিয়ে মায়ের হাতে ভাত খেতাম এখন নিজের হাতে খাই ।
যে সুখের আসায় আমি আমার মা কষ্ট করেছিলাম সে সুখ ঠিকই অন্যজনে করে আর আমি সেই আগের স্থানেই পরে রয়েছি।
মা যদি মারা যাওয়ার আগে বুঝতে পারতো যে সুখের জন্য সে কষ্ট করতে সে সুখ আমার কপালে নাই তাহলে সে সুখর জন্য কোনও কষ্ট করিতো। আসলে কপালের লিখন তো কেউ দেখতে পারে না।
0 Comments